নতুন সময়২৪.কম | আপডেট: 7:20 AM, August 15, 2022
১০ লাখ টাকা ঘুষ না দেয়ায় হত্যা মামলার প্রধান আসামি করে পুলিশ ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামান
নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ লাখ টাকা ঘুষ না দেয়ায় হত্যা মামলার প্রধান আসামি করে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম মো. রোকিবুজ্জামান। তিনি তৎকালীন চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন। বর্তমানে তিনি খুলনা জেলার ডিএসবি অফিসে কর্মরত।
ভুক্তভোগীর তথ্য মতে জানা গেছে, ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামান টাকা না পেয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে একজন নিরাপরাধ মানুষকে আসামি বানিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। ভুক্তভোগী কারাগার থেকে বের হয়ে ন্যায় বিচারের দাবিতে পুলিশ কর্মকর্তা রোকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।
তথ্য মতে জানা যায়, ভুক্তভোগী মাসুম কবীর নামের এক ব্যক্তি যশোরে প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ ডেন্টাল সেবাকেন্দ্র ‘ডেন্টিস্ট পয়েন্ট’-এর ব্যবস্থাপক পদে কাজ করার পাশাপাশি যশোর শহরের রেল রোডে অবস্থিত একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি কেন্দ্রের মালিকানা সদস্য ছিলেন।
কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল কবির তুহিনের সার্বিক দায়িত্বে পরিচালিত হতো। এই প্রতিষ্ঠানে মাসুম কবীর নামেমাত্রই সদস্য ছিলেন।
গেলো বছর ২০২১-এর ২২ মে সিসিটিভি ফুটেজের তথ্য মতে দেখা যায়, এদিন সকালে মাদকাসক্ত রোগীদের মধ্যে রুটি তৈরি করা নিয়ে ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একটি রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে সঙ্গে সঙ্গে মাদকাসক্তি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল কবির তুহিন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং ওই রোগীটিকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর এ ঘটনাটি একইদিন বেলা ১২টা ১৯ মিনিটের দিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ফোনের মাধ্যমে মাসুম কবীরকে জানানো হয়।
এ ঘটনায় নিহতের পরিবার একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আইও হিসেবে কাজ করেন তৎকালীন চাচড়া ইনচার্জ মো. রোকিবুজ্জামান। এ ঘটনায় তেমন কাউকে সে না পেয়ে প্রতিষ্ঠানের নামেমাত্র সদস্য মাসুমকে মামলায় জড়িয়ে দেবে বলে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দাবি করে। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে ওই মামলায় তাকে প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অন্যান্য আসামিদের তার নাম বলতে বাধ্য করা হয়।
এ ঘটনায় বিনা অপরাধে ভুক্তভোগী মাসুম কবীর ৪ মাস জেল খেটেছেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার কপাল খারাপ। এমন কপাল যেন অন্য কারোর না হয় সেজন্য তিনি রোকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়টি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাসুম কবীরের বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করছে। রোকিবুজ্জামানের ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি এবং বিনা অপরাধে তাকে মামলার আসামি করার বিষয়টির বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তারা মাঝে মাঝে এ বিষয়ে রোকনুজ্জামানকে বিভিন্ন জবাবদিহি করছেন।
মাসুম কবীর অভিযোগ করে বলেন, এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে, ন্যয় বিচারের পথ রুদ্ধ করে, সঠিক তদন্ত না করে এ ঘটনা তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন চাচড়া ফাঁড়ি ইনচার্জ ইনস্পেক্টর মো. রোকিবুজ্জামান ওইদিন রাতেই আমার কাছে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। টাকা দিতে অক্ষমতার পরিচয় ও অস্বীকার করলে রাতেই বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে আদালতে হস্তান্তর করে এবং পরবর্তীতে এ মামলার চার্জশিট প্রদানের কথা বলে নতুন করে আবারও সরাসরি ঘুষের দাবি করেন। পরবর্তীতে আসামি ও সাক্ষীদের জোরপূর্বক আমার নাম বলার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে অন্যান্য আসামি ও সাক্ষীরা এই পুলিশ কর্মকর্তার ভয়ে প্রথমে মিথ্যা কথা বলে এবং পরে তারা আদালতে সত্য কথা স্বীকার করে। এবং তারা আদালতকে জানায় জোরপূর্বক রোকিবুজ্জামান তাদের মাসুম কবিরের নাম বলতে বলছে। অন্যথায় তাদের মামলায় জড়িয়ে দেবে বলে হুমকি প্রদান করেছে।
ভুক্তভোগী মাসুম কবীর আরও বলেন, রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে কাজ করে তখন আসলে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা অসহায় হয়ে যায়, ঠিক আমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামানের অসৎ উদ্দেশ্য অর্থাৎ ঘুষ না দেয়ার কারণে আজ আমাকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে অথচ এই ঘটনাটির বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। সে ভেবেছিল মাসুম কবীরকে ধরলে হয়তো বড় অঙ্কের টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। এজন্য সে আমাকে আসামি করেছে মোটা অঙ্কের টাকা খাওয়ার জন্য কিন্তু আমি সেটা মেনে নিইনি। আমি তার অপরাধের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। এবং তার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছি।
তিনি বলেন, তাছাড়া আমি সুষ্ঠু বিচারের জন্য খুলনা ডিআইজি বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেছি এবং পুলিশ সদর দপ্তরে একটি অভিযোগ দায়ের করেছি। ইনশাল্লাহ আমার কাছে সমস্ত ডকুমেন্ট আছে ভিডিও ফুটেজ আছে, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ । ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামান আমাকে বাজেভাবে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিল। আমি যে সমস্ত অভিযোগ দায়ের করেছি সেই অভিযোগের ফিডব্যাক পাচ্ছি। এজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামান ঘুষ না পেয়ে আমার ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে দিয়েছে। ইনশাল্লাহ আমি একজন অসৎ পুলিশের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
তিনি বলেন, রোকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা, পুলিশ সদর দপ্তর, খুলনা বিভাগের ডিআইজির দপ্তরে অভিযোগ দেয়ায় সে আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। আমি সমাজের একজন সাধারণ মানুষ তার ঘুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আশা করি, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে আমি সহযোগিতা কামনা করছি।
তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা রোকিবুজ্জামান আমাকে যেভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে সেকারণে আমি নিরাপত্তাহীনতা ও পুনরায় হয়রানির আশঙ্কা করছি। এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাই। আমি ন্যয় বিচার চাই।
তথ্য মতে জানা গেছে, ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামান বর্তমান খুলনা বিভাগে ডিএসবিতে কর্মরত। সেখানেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তদন্তের রিপোর্টের বিনিময়ে ঘুষের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, যখন তিনি যশোর চাচড়া ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে ঘুষসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যশোর এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ইনস্পেক্টর মো. রোকিবুজ্জামান বলেন, আপনি যেভাবে বললেন ঘটনা আসলেই সেভাবে নয়। আপনি একটি মানুষকে হত্যা মামলার আসামি বানিয়ে দিয়েছেন কেন..? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিকটিমের বিরুদ্ধে তো আমি মামলা করিনি, যারা মামলা করেছে তারাই মাসুম কবীরের নাম বলছে।
তারা মাসুম কবীরের নাম বলেনি বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে আপনি জোরপূর্বক তাদের নাম বলিয়েছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি পক্ষপাতিত্ব করছেন বিষয়টি অন্যরকম।
সর্বশেষ রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের তদন্তে আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ হয়েছে বলে জেনেছি, এখানে কী জবানবন্দি দিয়েছেন? সেখানে কেমন ধরনের জবানবন্দি দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর জেলা পুলিশ সুপার দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে ইনস্পেক্টর রোকিবুজ্জামানকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তাছাড়া, খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি বরাবর ভুক্তভোগী যে অভিযোগ দিয়েছে সেটা আমলে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ বা কাউকে হয়রানির করছে এমন অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক পুলিশ সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং পুলিশ সদর দপ্তর তাদের অপরাধের সত্যতা পাওয়ায় অনেকে বিভিন্নভাবে সাজা ভোগ করছেন।
নতুন সময়/টিটি